রুপার কাছে খোলা চিঠি

রুপার কাছে খোলা চিঠি
জাকারিয়া আহমেদ


১।
রুপা
, মনে পড়ে, সেই প্রথম দেখার কথা? সারাদিন টুপ-টুপ টিপ-টিপ বৃষ্টি। ফার্মগেটের কৃষ্ণচূড়া তলে দাড়িয়ে বাসের অপেক্ষা। হঠাৎ তুমি এলে, সাদা রঙের লালপেড়ে শাড়ি, কপালে হলুদ টিপ, হাতে লাল-সবুজ চুড়ি।
সেদিন ছাতা আনতে ভুলে গেছিলে। তোমার সাদা শাড়ির উপর পানির দাগগুলো বেশ স্পষ্টই দেখাচ্ছিল। আজও ভাবতে অবাক লাগে কি বোকামি ভরা চোখে সেদিন তোমার বৃষ্টি ভেজা শরীরের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম।আমার উচিৎ ছিল তোমাকে ছাতার নিচে আশ্রয় দেয়া কিন্তু বোকামির কারণে সেদিন তা হয়ে উঠেনি।
সেই বোকামি ভরা চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ৫ মিনিট কাটিয়ে দিলাম। হয়তো আরও কিছুক্ষণ এই বোকামি চলতে পারতো। কিন্তু আমাদের সামনে শাহবাগের বাস।
২।
রাস্তায় জমে থাকা কাদা-পানি ছিটকে এসে আমাদের পায়ে লাগলো। ঠিক তখনই আমি বাস্তবে ফিরলাম। হুড়মুড় করে অন্য সবার মত আমরাও বাসে উঠলাম। বৃষ্টির দিন হওয়াই সিটের অভাব ছিল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে তুমি বসলে ঠিক আমার সামনের সিটে। তোমার চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ বারবার আমার সপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে ফারাক করছিলো।
তোমার সাথে দেখা হবার পর ভুলেই বসেছিলাম যে, সেদিন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস। শাহবাগে পৌঁছে তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নামতে গিয়ে তোমার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। কার্জন হলের সামনে এসে তোমাকে আবার মনে পড়ল। তখন আমার খুব খারাপ লাগছিলো জানো, মনে হচ্ছিল কোথাও কিছু একটা কম পড়েছে। তোমার সাথে আর কোনদিন দেখা নাও হতে পারতো, কিন্তু সেদিন আবার আমাদের দেখা হল। অবাক হলাম এই দেখে যে ,তুমি আমার বিভাগে ক্লাস করছ। তাখন শুধু হৈমন্তী গল্পের সেই লাইনটাই মনে উঁকি দিচ্ছিল, “আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম”
৩।
স্কুল- কলেজে কোনদিন কাউকে নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি শুধু বই নিয়ে। সেই বইও আমাকে নিয়ে খেলা করেছে। আমার রেজাল্ট দেখলে বুঝতে পারবা কি ধরনের খেলা সে করেছে! আমি ফেল করলেও এমন কষ্ট পেতাম না যতটা না ঐ রেজাল্টে পেয়েছি। যার জন্য স্কুল-কলেজে কাউকে নিয়ে ভাবিনি, হতে পারিনি কারো ভাল বন্ধু,সেই আমার সাথে এমন খেলা কি করে করল?
রুপা, তোমার সেদিনের কথা মনে পড়ে? সেই আমাকে? যে ছেলেটি প্রতিদিন তোমার চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ পাবার আশায় তোমার পিছে বসত। একদিন রায়হান তোমার পিছনে বসেছিল বলে, সারা ক্লাস তোমার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম।সেদিন স্বপন স্যারের কি বকাটাই না খেয়েছিলাম।
৪।
তোমাকে নিয়ে কল্পনায় কত ঘুরেছি। তুমি আমি হাতে হাত দিয়ে বৈশাখী মেলায় হেঁটেছি। পান্তা-ইলিশের মালসায় খুনসুটি করেছি। তোমাকে মাটির গয়না কিনে দিয়েছি। কি সুন্দরী না লাগতো তোমায় সেই গহনায়। মনে হতো মৃত্তিকা পরী।
বই মেলায় বই কিনতে গিয়ে যখন আমি শুধু হুমায়ুন স্যারের হিমুর বই কিনতাম তখন তুমি কত রাগ করতে। শীতের সময় আমার হলুদ পাঞ্জাবিতে যখন পোকা এসে জড়ো হতো তখন তুমি খুব মজা পেতে, বলতে “ খা খা হিমু বেটাকে গিলে খা”
তারপর তোমার সেই হাসি।
তুমি জেনে হয়তো খুশি হবে, মেলায় আর কোন নতুন হিমু আসবে না। পুরাতন হিমুরা বারবার ফিরে আসবে নতুন মোড়কে।
৫।
তোমার সাথে শেষ দেখার কথা খুব মনে পড়ে। সেদিন ক্লাসের সবাইকে তুমি
TSC তে কোক খাইয়েছিলে। আমি শুধু তোমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হালকা রঙের সেই নরম ঠোঁট।
আমি ভুলেই গেছিলাম আমার সামনে কোকের বোতল। তুমি আমায় স্পর্শ করে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলে। বলেছিলে “ খাচ্ছো না কেন?” এটাই তোমার আমার প্রথম কথা।
তুমি যাবার সময় বলেছিলে “সবাই ভাল থাকিস”। সেদিনও সেটার মানে বুঝিনি। বুঝিনি তোমাকে ছাড়া এতদিন ভাল
(!) থাকতে হবে।
৬।
রুপা তুমি কি জানো? আমি আজও ফার্মগেটে কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাড়িয়ে থাকি, লালপেড়ে সাদা শাড়ি, কপালে হলুদ টিপ, হাতে লাল-সবুজ চুড়িতে সজ্জিত তোমার সেই বৃষ্টি ভেজা শরীরের অপেক্ষায়.........।
আজ আর বোকামি করবনা। তোমার জন্য সবসময় একটা এক্সট্রা ছাতা কাছে রাখি। কখন তুমি বৃষ্টিতে ভিজে ছাতা ভুলে ফেলে আসবে? সব প্রস্তুতিই ঠিক আছে , গল্পের শেষ দৃশ্যের সেই মানুষটাই নেই।
কোনদিন কি আসবে?


পাদটীকাঃ যেখানে শুরুর কথা বলার আগেই শেষ।



মন্তব্যসমূহ